৪৮-৭২ ঘন্টায় ক্যাশ অন ডেলিভারি। ০১​৫​৮১১০০০০১​

পুখে'র বয়ানে আত্মহত্যা

April 30, 2025 by
পুখে'র বয়ানে আত্মহত্যা
Gronthik Operation

"সমাজবিশ্লেষণের প্রশ্নে ফরাসিদের পর্যালোচনাগুলির অন্তত একটা বড়ো কৃতিত্ব হলো - আধুনিক জীবন জিনিসটা যে স্ববিরোধী আর অস্বাভাবিক, এইটার উদাহরণ ওনারা স্রেফ ধনী-গরিব ইত্যাকার নানান শ্রেণীর পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে খুঁজে ক্ষান্ত হন নাই। বরং আধুনিক সমাজে মানুষের সাথে মানুষের মেলামেশার সম্ভাব্য সকল তরিকার মধ্যেই ওনারা স্পষ্ট করে দেখাইছেন, এই সমাজ কতটা অস্বাভাবিক এবং স্ববিরোধী। এবং মানুষের জীবন যে প্রাণময় একটা উষ্ণ ব্যাপার, এই ব্যাপারটা একটা উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে, পরিশুদ্ধ সূক্ষ্মতায়, বলিষ্ঠতম শুদ্ধ চেতনায় উনাদের পর্যালোচনাগুলিতে উঠায়ে আনছেন। যেইটা অন্য জাতিগুলির সমাজসংক্রান্ত আলাপ আলোচনায় আসলে খুইজা কোনো লাভই নাই। ওয়েন আর ফুরিয়ারের সমালোচনামূলক লেখাপত্রগুলি দেখেন, বুঝতে পারবেন ওনারা মানবজীবনের বিভিন্ন সম্পর্ক নিয়ে কি গভীরভাবে ভাবছেন। এইটা থেকে বুঝা যায় সমাজবিচারের প্রশ্নে ফরাসিরা কেন দুনিয়ায় সেরা"। (পুখে'র বয়ানে আত্মহত্যা, কার্ল মার্ক্স, অনুবাদ - ফারুক সাদিক)

সমাজবিজ্ঞান বলতে আমরা এই সময়ে যা বুঝি তার আধুনিক উৎস ফরাসিদের হাতে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম কারণ এই কথার সাথে মার্ক্স ও একমত। এবং যা কিছু মানবিক ও আণবিক, তা কিছুর সামাজিক দিক আছেই এবং সেই সব সামাজিক দিক ও প্রেক্ষাপটের সামগ্রিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিচার এবং সেই বিচারের আঙ্গিকে যে নব নব বিদ্যা তথা ডিসিপ্লিনের গোড়াপত্তন, তা ফরাসিদের দ্বারাই। উদাহরণ হিসেবে উনিশ ও বিশ শতকের নন্দিত ফরাসি সমাজবিজ্ঞানীরা, এমনকি বিশ শতকের সর্বোৎযাপিত ফরাসি দার্শনিক ও তাত্ত্বিক (যারা আদতে সমাজবিজ্ঞানী ই)। যে কোনো ঘটনা বা প্রবণতাকেই সামাজিক ঘটনা বা সামাজিক সম্পর্কে, সংমিশ্রণের, সংসর্গের জায়গা থেকে দেখায় ফরাসিদের জুড়ি নেই। আমার কথা না, স্বয়ং মার্ক্সের কথা, আমি তো পাঠক মাত্র। যাই হোক, মূল কথা হলো, মার্ক্সের অল্পবয়সের লেখাজোঁকা ও প্রাপ্ত বয়স্কের লেখাজোঁকা মাঝে একটা পার্থক্য করা হয়। পার্থক্য করার কারণ অবশ্যই আছে। আমার মতে লন্ডনে গিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বের সংস্পর্শে আসার আগ পর্যন্ত মোটাদাগে বলা যেতে পারে মার্ক্সের সকল লেখাই কম বেশি তার অল্পবয়সের লেখা। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো মার্ক্স তার কল্পিত উদ্ভাবিত যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডিসিপ্লিন যা আদতে তার সমাজতাত্ত্বিক বিচার বিশ্লেষণ, অর্থাৎ পুঁজিবাদের ব্যাখ্যা, তার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত নানা ধরণের তাত্ত্বিক ও জ্ঞান গত শাখায় বিচরণ করেছেন। ১৮৪৮ সালের আগ পর্যন্ত মার্ক্সের বিভিন্ন ইস্যু তে লেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ১৮৫০ এর পর দিয়ে মার্ক্সকে শুধুই তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তত্ত্বের (তার নিজস্ব তত্ত্ব) প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই লিখতে দেখা গেছে। কিন্তু মার্ক্স অল্প বয়সে (ছাত্র বয়স থেকে শুরু করে প্রাক-প্রাপ্ত বয়স্ক পেশাদারী) অর্থাৎ ১৮৫০ এর আগ দিয়ে অজস্র বিষয়ে লিখেছেন এবং যেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু রচনা পরবর্তী তে বিখ্যাত হয়েছিলো। খেয়াল করার বিষয় হলো ঐ সমস্ত লিখা গুলোতে দুই ধরণের চরিত্র দেখা যায়। একটি হলো যাকে বলে অনুসন্ধানমূলক লেখালেখি, অর্থাৎ বিভিন্ন ইস্যু ও শাখায় বিচরণ করা, আরেকটি হলো সেই সময়কার সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে লিখালিখি করা অর্থাৎ পত্রিকার কলাম হোক, কিংবা কারোর প্রশ্নের জবাব, অথবা কোনো বিতর্কে অংশ নেওয়া, কোনো বই বা তত্ত্বের পর্যালোচনা এরকম। মার্ক্সের অন জিউইশ কোয়শ্চেন প্রবন্ধটি ব্রুনো বাউয়েরের থিসিসের সমালোচনা, বা ইকোনোমিক এন্ড ফিলোসোফিকাল ম্যানুসক্রিপ্ট ক্লাসিকাল পলিটিক্যাল ইকনোমিস্ট (স্মিথ, রিকার্ডো, মিল) দের তত্ত্বের পর্যালোচনা, দ্য হোলি ফ্যামিলি ছিলো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে খ্রিষ্টানিটির সামঞ্জস্যতা বিষয়ক যে তৎকালীন বিতর্ক সেটাতে অংশ নেওয়া, পোভার্টি অব ফিলোসোফি ছিলো পি-জে প্রুঁধোর ফিলোসোফি অব পোভার্টির কড়া সমালোচনা, তো এই সব আর কি। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও এই সময়েই লিখা। এই সব গুলো লিখাই মার্ক্সের মোটামুটি ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই লিখা। তো মার্ক্সের অল্প বয়সী লিখার মধ্যে এই দুইটি চরিত্র প্রবল ভাবে দেখা যায় এবং মজার বিষয় হলো এই সময়ের প্রায় সকল লিখা ই সংক্ষিপ্ত অথচ সহজবোধ্য। এক কথায় ফরাসি কায়দায় লিখা! ফলে মার্ক্সের মতো পাঠক ও জ্ঞানের রাজ্যে এরকম অসংযমী, অবাধ, অস্বাভাবিক বিচরণকারী দুনিয়ায় আর কয়টা আসছিলো (বিশ শতকের আধুনিক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত বিদ্যাব্যসবস্থার পূর্বে) আল্লাহ মালুম!

তো অল্পবয়সী মার্ক্সের অনেক লিখাও বিখ্যাত হয়েছে পরবর্তীতে কিন্তু তারপরও মার্ক্স যে বিচিত্র বিষয়ে বিচরণ করেছেন, এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শব্দসীমায় সেইসব বিষয়ে লিখেছেন তার হিসাব নাই। "পুখে'র বয়ানে আত্মহত্যা" (Peuchet : On Suicide) বইটি সেইসব বেহিসাবের তালিকায় থাকা অন্যতম একটি। সোজা বাংলায় বললে বইটি মার্ক্সের লেখা হলেও মূলত এটা মার্ক্সের একটা বিবরণ বলা চলে। জ্যাঁক পুখে নামক বিপ্লবোত্তর ফরাসি সরকারের পুলিশ আর্কাইভের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বয়ান কেই হুবহু উপস্থাপন করেছেন মার্ক্স, বিষয় "আত্মহত্যা"। অর্থাৎ আত্মহত্যা বিষয়ক জ্যাঁক পুখের পর্যবেক্ষণ যা তার কর্ম-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি লিখেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন আত্মহত্যার কারণ ও কৃত্য। মার্ক্স, পুখের সেই সকল পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান, আলোচনা ও অনুমানকে উপস্থাপন করেছেন এই বইতে। উদ্দেশ্য ছিলো নব্য-আবির্ভূত আধুনিক সমাজকে বোঝা। পুখে'র উদ্দেশ্য ছিলো আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা এবং তিনি তাই করেছেন। পুখের বয়ান ও ব্যাখ্যা কে উপস্থাপন করে মার্ক্স আমাদের দেখাচ্ছেন আধুনিক সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতা, স্ববিরোধীতা, অস্বাভাবিকতা। পুখের মতে আত্মহত্যা মূলত সমাজের নানাবিধ অসুখের উপসর্গ তথা লক্ষণ হিসেবে হাজির থাকে। আর পুখের এই সূক্ষ্ম, সুচিন্তিত আলাপের রেশ ধরে অল্প বয়সী মার্ক্স আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে আধুনিক সমাজের গড়নই সমস্যাজনক। পুখে আমাদের নির্দেশ দেন আত্মহত্যা অস্বাভাবিক নয় বরং সমাজ ও সামাজিক সম্পর্কগুলো নিজেই অস্বাভাবিকতায় নিমজ্জিত, মার্ক্স তারই জের ধরে আমাদের ইঙ্গিত দেন যে এই অস্বাভাবিকতায় নিমজ্জিত সমাজ ও সামাজিক সম্পর্কগুলোর পরিণতি কি হতে পারে!  

সংক্ষিপ্ত কলেবরের বইটি পুরোটাই পুখে'র বয়ান এবং বয়ানের শেষে শেষে মার্ক্সের অল্পস্বল্প সংযোজন, কখনো বা গুরুত্বারোপ। সেই একই ফরাসি কায়দায় মার্ক্সের লিখা এই বই, অর্থাৎ বয়ান বা বিরবণনির্ভর একটি টেক্সট। তবে বইটির গুরুত্ব ও মূল্য নিয়ে বলার অবকাশ অনুবাদক ফারুক সাদিক দেননি। কেননা বইয়ের শুরুতেই বইটির মূখ্য বিষয় অর্থাৎ আত্মহত্যা বিষয়ক তিনটি মৌলিক দৃষ্টির বিষয়ে প্রায় ত্রিশ পাতার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটিতে অনুবাদক সাদিক আত্মহত্যা বিষয়ক প্রচলিত ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রথাগত মতামতের পর্যালোচনা করেছেন৷ আত্মহত্যা বিষয়ক যেই দুই তিনটি তাত্ত্বিক ডিসকোর্স রয়েছে সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছেন। অর্থাৎ আত্মহত্যা সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় সাইকোএনালিসিস এবং এমিলে ডুর্খেইমের সোসিওলজিকাল ডিসকোর্সের একট সাবলীল সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেছেন। সেই সাথে আবেদন করেছেন পুখে'র বয়ানে মার্ক্সের এই বইটির তাৎপর্য। পাশাপাশি আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক ঘটনা ও সামাজিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক সংকট হিসেবে দাখিল করেছেন নিজস্ব ভাবভঙ্গিতে। অনুবাদক সাদিকের এই প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে এই অনুবাদ বইটির একটি বুদ্ধিদীপ্ত অলংকার।

সংক্ষিপ্ত কলেবরের বইটি পুরোটাই পুখে'র বয়ান এবং বয়ানের শেষে শেষে মার্ক্সের অল্পস্বল্প সংযোজন, কখনো বা গুরুত্বারোপ। সেই একই ফরাসি কায়দায় মার্ক্সের লিখা এই বই, অর্থাৎ বয়ান বা বিরবণনির্ভর একটি টেক্সট। তবে বইটির গুরুত্ব ও মূল্য নিয়ে বলার অবকাশ অনুবাদক ফারুক সাদিক দেননি। কেননা বইয়ের শুরুতেই বইটির মূখ্য বিষয় অর্থাৎ আত্মহত্যা বিষয়ক তিনটি মৌলিক দৃষ্টির বিষয়ে প্রায় ত্রিশ পাতার একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটিতে অনুবাদক সাদিক আত্মহত্যা বিষয়ক প্রচলিত ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রথাগত মতামতের পর্যালোচনা করেছেন৷ আত্মহত্যা বিষয়ক যেই দুই তিনটি তাত্ত্বিক ডিসকোর্স রয়েছে সেগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছেন। অর্থাৎ আত্মহত্যা সম্বন্ধে ফ্রয়েডীয় সাইকোএনালিসিস এবং এমিলে ডুর্খেইমের সোসিওলজিকাল ডিসকোর্সের একট সাবলীল সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেছেন। সেই সাথে আবেদন করেছেন পুখে'র বয়ানে মার্ক্সের এই বইটির তাৎপর্য। পাশাপাশি আত্মহত্যাকে একটি সামাজিক ঘটনা ও সামাজিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক সংকট হিসেবে দাখিল করেছেন নিজস্ব ভাবভঙ্গিতে। অনুবাদক সাদিকের এই প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে এই অনুবাদ বইটির একটি বুদ্ধিদীপ্ত অলংকার।
 

WhatsApp Icon