মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলার আপামর খেটে খাওয়া মানুষের নয়নের মণি। শতাব্দীর সিংহপুরুষ ভাসানী আসাম থেকে শুরু করে পূর্ববাংলার পথে-প্রান্তরে অধিকারবঞ্চিত মানুষের কথা বলতে গিয়ে শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক দল গঠন থেকে শুরু করে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি যেমন ছিলেন অগ্রণী তেমনি স্বতন্ত্র শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন, বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের লড়াই, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানী ছিলেন রাজপথে-জনপথে। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড পূর্ববাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের মুখে ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘ওরা কেউ আসেনি।’ একই ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিবেশী ভারতের চাপিয়ে দেওয়া খরা বিষয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ফারাক্কা লংমার্চ বাস্তবায়ন করে।
আজীবন স্বাধীনতা ও সাম্যের সংগ্রামী মওলানা ভাসানী পূর্ণাঙ্গ কোনো আত্মজীবনী রচনা করে যেতে পারেননি, তবে সারা বাংলার মাঠে-ঘাটে জড়িয়ে আছে তাঁর আত্মকথা।
বর্তমান সংকলনে মওলানা ভাসানীর আত্মকথামূলক বেশকিছু রচনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। যাতে ভাসানীর জীবন ও দর্শন বিষয়ে সবাই বিশদ ধারণা লাভ করতে পারেন। সংকলনের দ্বিতীয় অংশে জীবনের বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও অন্যান্যের সঙ্গে তাঁর মূল্যবান কথোপথনও সংকলিত হলো যার মধ্য দিয়ে আলাপচারী মাটির মানুষ ভাসানীর প্রতিকৃতি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে।
বইয়ের কাজটা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে গিয়েছে। কতটা পাষাণ হতে পারে মানুষ! একটা ছেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হতেই পারে, তাই বলে এভাবে নির্যাতন করা লাগবে? নির্যাতনের ঘটনাগুলো পড়লে আপনি আঁতকে উঠবেন। একজন শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে হকিস্টিক, এসএসের পাইপ, রড, স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হচ্ছে। কখনো-বা প্লাস দিয়ে হাত-পায়ের নখগুলো টেনে তুলে ফেলছে। কান টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। শরীরে গরম পানি ঢেলে দিচ্ছে। এত নির্যাতনের পরও এদের অন্তর তৃপ্ত হতো না। অনেককে নির্যাতন শেষে আধমরা করে রুমের জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিত। মৃতপ্রায় তৃষ্ণার্ত এক শিক্ষার্থী পানি চাইলে তাকে পানির বদলে ওই কুকুরগুলো নিজের প্রস্রাব দিয়ে বলে, এই নে পানি না আমার প্রস্রাব খা। ভাবা যায় কতটা পশুত্বে পরিপূর্ণ ছিল এদের মস্তিষ্ক?
রক্তাক্ত জুলাই, বাংলাদেশের অধ্যায়ে অঘোষিত আর এক স্বাধীনতার নাম, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই বাকস্বাধীনতা, এই কবিতার বই আপনাকে আন্দোলনের মাঠে নিয়ে যাবে, আপনার চোখ ছল ছল করে উঠবে, এই কবিতার বই নিপীড়িত মানুষের কথা বলবে, জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেই কথা বলবে, অবশেষে ভালোবাসার স্পর্শে আপনাকে শীতল করবে ! রক্তাক্ত জুলাই, যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতি অমর করে রাখবে এই বই , যারা শহীদ হয়েছেন, নিঃস্বার্থভাবে জীবন দিয়েছে, যারা শরীরের অঙ্গ হারিয়েছেন, যারা জুলাইয়ের আন্দোলনকে গতিশীল করেছেন রাজপথ কিংবা অনলাইনে, তাদের সাক্ষী এই রক্তাক্ত জুলাই হয়ে থাকবে !
এ সংকলনের একটি আকর্ষণের দিক হলো এখানে নেই কোনো প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাত যশওয়ালা কবি। মাঠের কর্মী ও কবিরাই শব্দে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন জুলাই বিপ্লবের ইলহাম।
বিপ্লবী কবিকুলকে আহ্বান করে উত্তাল দিনগুলোতে লেখা।
‘কবি, রাজপথে কবিতা আঁকো’ শিরোনামে লেখা একটি কবিতার কিছু পঙ্ক্তি দিয়ে আলাপ শেষ করি:
আজ রাজপথ খালি; জরুরি অবস্থা আর কারফিউতে সব ভীতু কবিদল, পদ্যকার, ছড়াকার ঘরে ঘুমুচ্ছে ঘোরে-বেঘোরে।
কবিতা লিখতে না পারো, ঘরে বসে থেকো না, বের হয়ে যাও পথে-গলিতে, ফুটপাতে অথবা রাজপথে।
পুরো রাজপথ যে তার শূন্য খাতা খুলে বসে আছে— আমার অপেক্ষায়, তোমার অপেক্ষায়। কখন তার পৃষ্ঠায় আমার পা দিয়ে এঁকে দিবো, তোমাদের পা দিয়ে এঁকে দিবে আমার সেই অমর কবিতাটি, তোমাদের সেই অমর কবিতাটি।
এখন আমি ফুটপাত ছেড়ে রাজপথের খোলা পৃষ্ঠায় কবিতা আঁকছি, একটি হাত দিয়ে নয়, দুপায়ে— ছন্দের তালে তালে—